‘ইউজার এক্সপেরিয়েন্স’ টার্মটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে। ১৯৯৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন ল্যাব এর ডিরেক্টর ডন নরম্যান ইউজার এক্সপেরিয়েন্সকে নতুনভাবে সবার সামনে নিয়ে আসেন।[1] তখন থেকে ইউজার এক্সপেরিয়েন্সকে নিয়ে মানুষ নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে।
ইউজার এক্সপেরিয়েন্স এর এই নতুন যাত্রা তিন দশকের হলেও মানবকে কেন্দ্র করে ডিজাইনের ধারণা অনেক আগের। আজ থেকে ৬০০০ বছর পূর্বে (৪০০০ খ্রিষ্টপূর্ব) চীনে ‘ফেং শুই’[2] (বায়ু-জল) নামের একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেখানে বলা হয়, ঘরের মালপত্র এমনভাবে সাজানো হবে যেন বাতাস-পানি চলতে কোন অসুবিধা না হয়। চারপাশের জায়গা সর্বাধিক অনুকূল ও ব্যবহারকারী-বান্ধব করে সাজাতে হবে — এবং এটি বাসা, বাহিরে, কাজের জায়গায় সবখানেই হতে পারে। এবং তারা তখন বাসা-বাড়ি তৈরিতে, মালপত্র সাজাতে এমনকি রং করার সময়েও ব্যবহারকারী-বান্ধব সমাধান বের করে। মূলত পরিবেশের সাথে মানুষের নন্দনশীলতার পরিচয় ঘটে সে সময় থেকে।[3]
বাংলাদেশে কম বেশি ইউএক্স ডিজাইন সম্পর্কে কারো জানা থাকলেও ইউজার এক্সপেরিয়েন্স (ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা) এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় ‘ইউজারহাব’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠনটি যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, ব্যবহারকারীর প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমান ইউএক্স ডিজাইনারের ঘাটতি রয়েছে। আর তা পূরণের লক্ষে ইউএক্স ইনস্টিটিউট হিসেবে ইউজারহাব তার পরিক্রমা শুরু করে। সেই থেকে তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইউএক্স ডিজাইনারের যে ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পন্য বা সেবায় ইউএক্স নির্ভর সমাধান দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউজারহাবের অভিজ্ঞ টিমটিতে রয়েছে ইউজার রিসার্চার, ইউএক্স আর্কিটেক্ট, ইন্টারফেইস ডিজাইনার, ইনফরমেশন আরকিটেক্ট স্পেশালিস্ট, ভিজুয়াল এবং গ্রাফিক ডিজাইনার, কন্টেন্ট রাইটার। এই অভিজ্ঞ টিমের কাজ হচ্ছে সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মানব-কেন্দ্রিক সমস্যাগুলোর সমাধান নিশ্চিত করা।তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকারের “এক সেবা নাগরিক” এ কাজ করেছে। বাংলাদেশের বৃহৎ কিছু ই-কমার্স বেইজড ওয়েব সাইট এবং এপের ইউএক্স ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টের কাজ করেছে।
বর্তমানে ওয়াশ এলায়েন্স এর এসডিজি’র সাব প্রোগ্রামে গবেষণার অংশে কাজ করছে। গবেষণা শেষে মানুষ থেকে উঠে আসা সমস্যা সমাধান করে ডিমান্ড ক্রিয়েশনে কাজ করবে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েব ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রেও ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ব্যবহার করে কেস স্টাডি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইউজারহাবের কো-ফাউন্ডারদ্বয় নিলীম আহসান এবং ওয়াহিদ বিন আহসান অবশ্য তারও আগে থেকে ইউএক্স নিয়ে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। ‘ইউএক্স স্যাটারডে উইথ ওয়াহিদ’ (UX Saturday with Wahid) নামে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে প্রথম অনলাইন ওয়েবিনার এর মাধ্যমে তরুণদের ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন ও মানব-কেন্দ্রীক ডিজাইনে উৎসাহিত করে। পরে, ২০১২ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থি ও তরুণ প্রফেশনালদের উদ্দেশ্যে সরাসরি ওয়ার্কশপ শুরু করে। এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানব কেন্দ্রিক ডিজাইনের মাধ্যমে ইউজারকে কিভাবে একটি সহজ সমাধান দেয়া যায় সেটি গবেষনার মাধ্যমে বের করে এনে সেটির ফাইনাল প্রোডাক্টটি কিভাবে ডিজাইন করবে তা শেখানো।
সেসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলোজি (আইআইটি), কুয়েট, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ডুয়েট সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০০ এর বেশি শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রফেশনালরা এই ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে শেখার সুযোগ পেয়েছেন।
শুধু এতটুকুই নয়, পাশাপাশি ডিজাইন কমিউনিটির কন্ট্রিবিউশনের দিক দিয়েও প্রতিষ্ঠানটি অনেক অবদান রেখে আসছে। ২০১৫ সালে ইউজারহাব, ইউএক্স সাটারডে উইথ ওয়াহিদ এবং বাংলাদেশ ইউজার এক্সপ্রিয়েন্স প্রফেশনাল’স এসোসিয়েশন এর যৌথ উদ্যোগে রংপুরে বাংলাদেশে প্রথম “বিগ ডিজাইন ডে” আয়োজিত হয়। একই বছর ডিজাইন ও টেকনোলজির গবেষণাধর্মীর কন্টেন্ত প্লাটফর্ম “টেকমরিচ” এর যাত্রা শুরু হয়।
এরপর ২০১৬ , ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ এ ডিজাইন থিঙ্কিং নিয়ে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মানের বুটক্যাম্প পরিচালনা করে আসছে ইউজারহাব। ডিজাইন থিঙ্কিং বুটক্যাম্পটি সারাদিনব্যপী হয়। ডিজাইন থিংকিং ওয়ার্কশপে প্রত্যেকে একটি সমস্যা চিহ্নিত করে। তারপর দলবদ্ধভাবে সেটার মানব-কেন্দ্রিক সমাধান বের করা হয়। এর ফলে, একজন শিক্ষার্থী খুবসহজে মানব-কেন্দ্রিক ডিজাইন এর ব্যবহারিক ধারণা পায়। বুটক্যাম্পে ইউএক্স প্রফেশনালস, ইউএক্সে আগ্রহী তরুণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ উপস্থিত থাকেন। আয়োজনে বিশ্ব সমাদৃত একজন ইউজার এক্সপেরিয়েন্স এক্সপার্ট বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকেন। তৃতীয় বুটক্যাম্পে ইউএক্স এর পথিকৃৎ ডন নরম্যান ক্লাস নেন। ২০১৯ সালে ইনফরমেশন আর্কিটেকচার এর জনক পিটার মরভেল বুটক্যাম্পে ক্লাস নেন।এসকল আয়োজনে ইউনিসেফ, সেভ দ্যা চিলড্রেন, ব্রাক, গ্রামীনফোন, বাংলালিংক, রবিসহ টেলিকমিউনিকেশন, সফটওয়্যার এপ্লিকেশন ফার্ম, এনজিও সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।
ইউজার এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে ইউএক্স সাটারডে উইথ ওয়াহিদ শুরু হওয়ার পর ইউএক্স নিয়ে অনেকেই কাজ শুরু করে। তবে, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা এর আগে কারো পাওয়া যায়নি। ফলে, বাংলাদেশে ইউএক্স পথচলায় এই প্রতিষ্ঠান ও ফাউন্ডারদ্বয়ের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবদান অভাবনীয়।
ইউজারেহাবের কো ফাউন্ডার’রা সর্বস্তরে ইউএক্স প্রসার নিশ্চিত করতে এখনো বিশেষ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে রয়েছে, নারীদের জন্য “আভা’ নামক একটি নিজস্ব প্রকল্প। এ প্রকল্পে মেধাবী নারীদের জন্য স্বল্প খরচে ইউএক্স ডিজাইন শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের সাথে এডভোকেসি করে যাচ্ছে।
হামিমুর রহমান ওয়ালিউল্লাহ
[1] https://careerfoundry.com/en/blog/ux-design/the-fascinating-history-of-ux-design-a-definitive-timeline/
[2] Michael R. Matthews (30 August 2017). History, Philosophy and Science Teaching: New Perspectives. Springer. p. 31. ISBN 978-3-319-62616-1.
[3] https://careerfoundry.com/en/blog/ux-design/the-fascinating-history-of-ux-design-a-definitive-timeline/