মেশিন’ই একদিন আমাদের মৃত্যুহীন সমাজের স্বপ্ন দেখাবে!

September ৫, ২০১৫

সব ক্ষেত্রেই যে প্রযুক্তির টানে সবকিছু স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা প্রয়োজন, ব্যপারটি এমনও না। মজার ব্যাপার হল, যতই প্রযুক্তির উন্নতি হোক না কেন, যতদিন পর্যন্ত যন্ত্র থাকবে ততদিন পর্যন্ত সেই যন্ত্রকে পরিচালনা করার জন্য একটি মানুষ লাগবেই। যখন গুগল সার্চ ইঞ্জিন আবিস্কার হল, তখন সবাই ভাবল হায়! লাইব্রেরিয়ানদের দিন বুঝি শেষ! কিন্তু উলটো দেখা গেল লাইব্রেরিয়ান দের কদর দিন দিন বেড়েই চলেছে। “ একটি মেশিন যদি আমার জায়গায় কাজ করা আরম্ভ করে, হ্যাঁ আমি অপাংতেয় সত্যি! কিন্তু এই আমাকেই যদি এখন মেশিনটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে আমি তখন আগের চেয়েও অনেক বেশী গুরত্তপূর্ণ হয়ে উঠব”। বলছিলেন AUTOR.

মূল ব্যাপারটিই এখানে, যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ একক আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে, মেশিন বা সফটওয়ার কখনই মানুষের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। যতই নিখুঁত হোক না কেন একটি যন্ত্রের সামর্থ্য কোনদিনই মানুষের অসীম বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা কিংবা আবেগকে ছুঁতে পারবে না। তাই পাদ্রি, ধর্মযাজক, নার্স, কেয়ারটেকার, ট্রেইনার কিংবা এনটারটেইনার এর মতন পেশাগুলোতে যন্ত্রের দখল নিতে আরও কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে।

FREY মনে করেন “একইভাব কোন কিছু স্বয়ংক্রিয় করতে পারা মানেই যে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই করতে হবে তা নয়”। এখন যদি রেস্তুোরাতে ওয়েটার এর বদলে ট্যাবলেট ফোনে খাবার অর্ডার নেয়া হয় আর মানুষের বদলে একটা রোবট এসে খাবার সার্ভ করে যায়, ব্যপারটি মোটেও মানুষের কাছে দৃষ্টিসুখকর হবে না। এটিই খুবই সাধারন ব্যাপার যে মানুষ এসকল সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে অন্য আরেকটি মানুষের সান্নিধ্যই সবচেয়ে বেশী পছন্দ করে। আর তাই এখনও অবাক হুলেও সত্যি ব্রুকলেন থেকে লন্ডন, বার্লিন থেকে পোর্টল্যান্ড পর্যন্ত শহরগুলোতে হাতের তৈরি ফার্নিচার, কানের হেডফোন কিংবা হাতে বানানো মাশরুম থেকে শুরু করে মায়োনিজ পর্যন্ত খাবারগুলোর কদর ঠিক আগের মতই আছে। একদিকে যেমন যন্ত্রের অনুপস্থিতি জিনিসগুলোর কদর কে মানুষের কাছে আকাশচুম্বী করছে অপরদিকে ESTY  এর মতন কোম্পানিগুলো যন্ত্রের উপস্থিতির সাহায্যেই তাদের মার্কেটকে বাড়িয়ে দিনকে দিন মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। সত্যি বিচিত্র এই মানব চরিত্র।

তাই নির্দ্বিধাই একথা বলায় যায় যে, প্রযুক্তির আগ্রাসন একদিকে মানুষের কাজের ক্ষেত্র যেমন বন্ধ করে দিচ্ছে, অপরদিকে নতুন নতুন ক্ষেত্রকে করছে উন্মোচন। যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, কমিউনিটি ম্যানেজার, এপ ডিজাইনার, গ্রিন ফিউনারেল ডিরেক্টর এর মতন পদগুলো নিত্যনতুন আবিস্কার হচ্ছে যা এই ১৯৯৫ সালের দিকেও মানুষের কাছে অকল্পনীয় ছিল। আর তাই সামনে যে মানুষের জন্য কি অপেক্ষা করছে, তা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারব না। এখুনি আমরা দিব্য চোখে বলে দিতে পারি যে এমন একটা সময় আসবে যখন জেনেটিক কাউনসিলর, সফটওয়ার ডিবাগার, বায়ো ব্যাংকার, অগমেনটেড রিয়েলিটি অথর কিংবা এনটি এজিং স্পেশিইয়ালিস্ট এর মতন প্রযুক্তি নির্ভর পেশাগুলোর চাহিদা মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে। মানুষ যত বেশী শহরমুখী হচ্ছে তত বেশী যন্ত্রের সাথে নিজেকে আরও বেশী সম্পৃক্ত করে তুলছে।

কিন্তু এই যে মানুষের সাথে যন্ত্রের যে এক পালাবদল, এটি খুব সহজেই ঘটবে বলে ধরে নেওয়া যায় না। অতীতে যায় হোক না কেন, মানুষকে যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত করে তুলতে আরও বেশী সময় দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তির আগ্রাসনই হয়ত আমাদের জীবন যাত্রাকে উন্নত করে তুলবে সত্যি! কিন্তু এই উন্নতির ছোঁয়াও সবার কাছে সমান ভাবে পৌঁছে দেয়া জরুরী। AUTO বলছেন “হ্যাঁ আমরা মানলাম আমরা একসময় যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব সত্যি! আমরা আগের চেয়ে অনেক অল্প সময়ে, অল্প শ্রমে অনেক বেশী সম্পদ তৈরি করতে সক্ষম হব এবং সত্যি সত্যি তখন হয়ত আমাদের হাতে চাকুরী থাকবে না। কিন্তু মূল সমস্যাটা হল, যদি চাকরিই না থাকল, তাহলে এই যে এত সম্পদ এগুলো মানুষ কিনবেই বা কিভাবে? আর কিভাবেই বা সকলের মাঝে সমান ভাবে বণ্টন হবে?”।

“সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে হলেও মানুষ হয়ত এখুনি বেকার হয়ে পড়বে না, কিন্তু বাস্তবতা হল এই বেকারত্তের বদলে আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষকে আরও বেশী নিরাপত্তা দিতে পারব”। _ এমনটাই মনে করেন MIT Initiative on the Digital Economy এর ডিরেক্টর এবং The Second Machine Age এর লেখক Erik Brynjolfsson

একই সাথে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিববর্তন আনা অতীব জরুরী। আমাদের এখন প্রশ্ন করতে হবে, আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবাস্থা কি সত্যি যুগোপযোগী? আমরা কি সত্যি আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের জন্য বড় করে তুলছি? Sandar এর মতে “অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের শিক্ষার্থীরা এমন সকল শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে যা বাস্তব বর্তমান কর্মক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে। যার ফলে তারা বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না”। কিছু কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আজকাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। Sandar দেখেছেন “ফ্রান্স যেমন একদিকে Uber এর মতন প্রতিষ্ঠানকে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে দিচ্ছে অপরদিকে জার্মানির মতন দেশ প্রতি বছর প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোককে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলছে”। এখন বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৪০০০ এরও বেশী কোম্পানি সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে প্রযুক্তি ওয়াকিবহাল জনশক্তি তৈরি করে যাচ্ছে। এর মধ্যে INFOSYS সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে একটি যারা ২০০১ সাল থেকে মিশর, ইন্ডিয়া প্রভৃতি দেশসমুহে প্রায় ১০০,০০০ জন ইঞ্জিনিয়ারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যার ফলে বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি গুলো তাদের লোকদের চাকরিচ্যুত করার চাইতে তাদের কাজে লাগানোর প্রতি বিশেষ মনযোগী হয়েছে। BMW এর মতন বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আজকে তাদের পুরনো কর্মীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তির সাথে দক্ষতার সমন্বয় করতে চাচ্ছে।

এটা সত্যি যে যন্ত্রই একসময় মানুষের জায়গা নিয়ে নিবে। Brynjolfsson মনে করেন “ এমন সময় খুব বেশী দূরে নয় যখন যন্ত্রই মানুষের সব কাজ করে দিবে, এবং মানুষ চাইলে সারাদিন কোন কাজ না করে সারাদিন আরাম করে কাটিয়ে দিতে পারবে”।

স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আগ্রাসন যে সব ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা বলার কোন উপায় নেই, এগুলো আমাদের সম্পদ এবং জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করবে। যেমন নরওয়ের মতন দেশ, যাদের জিডিপি কিনা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রচণ্ড ঈর্ষনীয়, তাদের অধিবাসীরা সপ্তাহে মাত্র ৩৩ ঘণ্টা কাজ করে। শেষ পর্যন্ত  হয়ত AUTOR এর কথাই সত্যি হয়ে উঠবে, “ এই যন্ত্রই একদিন আমাদের মৃত্যুহীন সমাজের স্বপ্ন দেখাবে”। (পর্ব – ১)  (পর্ব – ২)

Tech Ninja – Techmorich