‘গোল্ডেন রাইস’ কতটা গোল্ডেন? – (পর্ব-২)

September ১৪, ২০১৫

গোল্ডেন রাইস আবিস্কারের পর পুরো পৃথিবী জুড়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। এক পক্ষ এই গোল্ডেন রাইসকে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখলেন। আরেক পক্ষ, বিশেষ করে পরিবেশবাদীগণ (Environmentalist) এবং এন্টি-গ্লোবালাইজেশন (Anti-globalization) কর্মীরা খুব জোরে শোরে এর বিরোধীতা শুরু করলো। তারা এটিকে পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখলেন। অবশ্য এর কিছু কারণও রয়েছে। গোল্ডেন রাইস তৈরী করা হয়েছে জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের নিজস্ব মেকানিজমকে কৃত্রিমভাবে কিছুটা পরিবর্তন বা রুপান্তরিত করা হয়। এর ফলে ঐ উদ্ভিদ যে ফসল বা ফল উৎপন্ন করে, সেটাকে বলে GM (Genetically Modified) crops. এই ফসল বা ফল তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অতিরিক্ত কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এই ফসলগুলো হয় অধিক পুষ্টি সম্পন্ন, অথবা রোগ-পোকা মাকড় প্রতিরোধী, খরা-লবণাক্ততা-বন্যা প্রতিরোধী অথবা অধিক উৎপাদনশীল।

গোল্ডেন রাইস আবিস্কারের পূর্বে ভুট্টা, গম, টমেটো, তুলাসহ আরো কিছু GM crops আবিস্কৃত হয়েছে এবং বেশ কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। কিন্তু, কোন কোন GM crops বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তৈরী হয়নি। ফলে এসব পরিবেশের জন্য কিছু সমস্যা তৈরী করছে। কিছু জিএম ফুডকে আবার মানুষের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেও দায়ী করা হচ্ছে। এসবের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে পরিবেশবাদী এবং বিভিন্ন মানবাধীকার সংগঠন সবসময়ই জিএম ফসল এর বিরোধীতা করে। সেই কারণেই তারা প্রবলভাবে কৃত্রিমভাবে তৈরী গোল্ডেন রাইসের বিরোধীতা করছে।

অবশ্য বিজ্ঞানীরা তাদের বিরোধীতার জবাব দিয়েছেন চমৎকারভাবে। বিরোধীতাকারীদের দাবী ছিলো, গোল্ডেন রাইস পর্যাপ্ত পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন তৈরী করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা এর উত্তর দিলেন ভিন্নভাবে। তারা গবেষণা করে আবিস্কার করলেন ‘গোল্ডেন রাইস ২’ যা আগের আবিস্কৃত গোল্ডেন রাইসের চেয়ে ২৩ গুণ বেশি বিটা-ক্যারোটিন তৈরী করতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মানুষের উপর এই চাল কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আগে আবিস্কৃত GM crops গুলো নিয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করছে এবং তারা তাদের ইচ্ছেমতো এগুলো ব্যবহার করছে। কিন্তু, এই গোল্ডেন রাইসকে বিজ্ঞানীরা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। যে কেউ চাইলেই এটি চাষ করতে পারবে, এমনটি গবেষণাও করতে পারবে।

গোল্ডেন রাইস বিভিন্ন দেশে এখনো পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। বাজারে উন্মুক্ত হতে আরো কিছু সময় নেবে। আশা করা হচ্ছে বাংলাদেশেও বছর খানেকের মধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে এটির চাষাবাদ শুরু হবে।

কোন নতুন আবিস্কারকে গ্রহন করতে মানুষের সময়ের প্রয়োজন হয়। কেউ এটিকে বিজ্ঞানের দান বলে গ্রহন করবে আর কেউ এটিকে প্রকৃতির বিরুদ্ধচারণ বলে প্রত্যাখান করবে। আর তা যদি হয় খাদ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে, তাহলে তো বিতর্ক হবেই। পরিবেশবাদীদের দাবী, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের পরিবর্তন সমগ্র বায়োডাইভারসিটিকে (Biodiversity) হুমকিতে ফেলবে। এই সোনালী চাল অন্যান্য প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা ধানের প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে দেবে। অথবা প্রত্যাশিত ভাইটামিনের বদলে ভয়ানক সব রোগ তৈরী করবে। আর বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সোনালী চাল পৃথিবীর কোটি কোটি শিশুকে রক্ষা করবে অন্ধ হবার হাত থেকে। দেখা যাক, সময়ই বলে দেবে এই সোনালী ধান কি সত্যিই আমাদের জন্য সোনালী ভবিষ্যতের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারবে কিনা।

(পর্ব-১) 

Tech Analyst – Techmorich