বাবা-মার স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় ডাক্তার হবে। যেমনটি সব বাবা-মা চায়। কিন্তু ছোট থেকেই আর্টিস্ট হবার জন্য দানা বাঁধে অনিকের শিল্পী মন। আমাদের আজকের শিল্পী অনিক কুণ্ডু। প্রবল ইচ্ছেশক্তি আর চেষ্টা থাকলে যে কোন স্বপ্নই বাস্তবায়িত হতে পারে।অনিকের শিল্পী হয়ে উঠার গল্প নিয়ে আজকের টেকমরিচের আয়োজন ।
নাম: অনিক কুন্ডূ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা অনুষদের অংকন ও চিত্রায়ন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। জন্ম বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার জগন্নাথ পাড়ায়। ছোট বেলা থেকেই ছবি আঁকতাম। কাগজ পেনসিল আর রঙ নিয়ে খেলতাম। কালো সিলেট, বাসার মেঝে, আঙিনা,চক, বাঁশ, পাট কাঠি এসব নিয়ে খেলতাম, আঁকতাম। তখন জানতাম না শিল্প কি, শিল্পী কি। এসব বোঝানোর মত কেউ ছিল না। বই পড়ে, টিভি দেখে, পত্রিকা পড়ে জানতে থাকলাম শিল্প কি, কি এর গুরুত্ত, কি এর মাহাত্ম্য। বড় বড় শিল্পিদের জীবনী পড়লাম, জানলাম। এভাবে জানতে জানতে কখন যে মনের ভেতর নিজেকে শিল্পি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য গড়ে উঠেছে তা বুঝতেও পারিনি। বুঝতে পেরেছি এইচ এস সি পরীক্ষার পর। কেননা,বাবা মা সর্বদাই চাইতো আমাকে ডাক্তার বানাতে। কেন চাইতো সেকথা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কারো অজানা থাকার কথা না। আমার বিজ্ঞান ভাল লাগতো, এখনো লাগে । তবে নিজেকে ডাক্তার হবার কথা কখনো মনে সায় দিত না। ডাক্তারি পড়ানোটা আমার উপর বলতে গেলে জোরপুর্বক চাপানো এক ইচ্ছা ছিল। তবে বাবা মাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। তারা কখনো ছবি আঁকা আকি পছন্দ করতো না।নিছক সময় নষ্ট ছিল তাদের কাছে। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি দুটোতে সাইন্স থেকে গোল্ডেন এ+ পাওয়া ছাত্র কি আর চারুকলায় পড়ে! অনেক কষ্টে মেডিকেলের কোচিং পালিয়ে চারুকলায় ভর্তি কোচিং করতে যেতাম সকলের অগোচরে। একজনের কথা না বললেই নয়। মৌমিতা সরকার যার জন্য হয়তো আজো আমার এ মেধাকে টিকিয়ে রেখেছি নইলে হয়তো আজ কোন মেডিকেলের ছাত্র হয়ে ভর্তি কোচিং এর ছাত্রদের পরামর্শ দিতাম। মৌমিতার জন্য চারুকলা ভর্তি কোচিং এ ভর্তি হতে পারি। আর্থিক, মানসিক সাহায্য এমন কিছু নেই যে সাহায্য বাকি রেখেছে। বলতে গেলে ভর্তি পরীক্ষার পরবর্তী সময় থেকে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। শিল্পি হতে চাই, ছোটবেলা থেকে যে সপ্ন টা দেখে আসছি সেটা পূরন করাই এখন আমার লক্ষ্য আর কর্তব্য ।আর বাবা মা কে এখন একটাই কথা বলি, দেখো, ‘ডাক্তার না হতে পারি নামের আগে ডক্টর ধারী একজন শিল্পী হবো একদিন।’
আমার কাজ ও কাজের ধরন: মূলত মানুষ তাই করে যা তার ভাললাগে, যা সে ভালবাসে। তবে মন থেকে কিছু করলে সেখানে সেরাটা দেওয়া যায়। এখন ছবি আঁকাটাই আমার পড়াশোনা। ছবি আঁকার অনেক মাধ্যম পেন্সিল, জল,তে্ এক্রিলিক ইত্যাদি ইত্যাদি আছে। সব কিছুতেই আঁকি তবে এর মাঝে কয়লা আর চক ভাল লাগে আর ক্যানভাস হিসেবে ভাল লাগে বাঁশ ( শিল্পের ভাষায় ব্রাউন পেপার) আর সাবজেক্ট হিসেবে মানুষের সুন্দর চেহারাটাই ভাল লাগে। ছেলেবেলায় চক দিয়ে সিলেটে লিখতাম (বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়) তাই মাধ্যম হিসেবে চক (শিল্পের ভাষায় সাদা চারকোল) (বাংলাদেশে পাওয়া যায় না) ভাল লাগে। দোকান থেকে এই ৩ টাকা দামের কাগজ কিনে তাতে মানুষের ছবি আঁকি একটু অন্যভাবে আঁকার চেষ্টা করি। মানুষের চেহারা অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি পুরাতন জিনিস নিয়ে নতুন কিছু করার। এছাড়া মিশ্র মাধ্যমও ভাল লাগে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিল্প ক্ষেতে অগ্রসরে সমস্যা: সমস্যার কথা বলতে গেলে প্রথমে মানসিক সমস্যার কথা বলতে হয়, সেই সাথে আর্থিক সংকট। ছবি আঁকার ভাল সরঞ্জাম পাওয়া যায় না, আমি নিজেও অনেক কিছু বাইরে থেকে আনাই। দেশে এসবের আমদানি বাড়াতে হবে। সেই সাথে উৎপাদন। তাছাড়া উন্নয়নশীল এ দেশে ছবি আঁকাকে ৮৫% মানুষ সময় নষ্ট বলে মনে করে, আর চারুকলায় পড়া? সেতো ভবিষ্যত অন্ধকার। অধিকাংশ মেধাই ঝড়ে পড়ে পিতা মাতার ভুল সিদ্ধান্তের কারনে। যে যেই গুনাবলি নিয়ে জন্মেছে তার সেই গুনের বিকাশ না ঘটিয়ে অন্য গুনের বিকাশ ঘটাতে তারা ব্যস্ত। বাংলাদেশের বাইরে উন্নত সব দেশে শিল্প ও শিল্পির যে কত কদর, মূল্য তার ১% ও বাংলাদেশে নেই।
তবে আশার কথা যে এখন অনেক উন্নতি হচ্ছে। বর্তমানে পেশার ক্ষেত্র বাংলাদেশেও চারুকলায় পড়ার বেশ ভাল ভবিষ্যত। তবে এটা অধিকাংশের’ই জ্ঞানের বাইরে। সরকার শিল্পের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে। ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত চারুকলা বাধ্যতামূলক করেছে।ভবিষ্যতে এইচএসসি পর্যন্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে শুধু মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিএ, ল ইত্যাদি ই একমাত্র ভাল পড়াশোনা নয়, চারুকলা, ডিজাইন এসব নিয়ে পড়ার ও অনেক ভাল ভবিষ্যত আছে। এই জ্ঞান মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে, সবাইকে অবগত করতে হবে। যাতে কোন অভিভাবক ভবিষ্যত শিল্পিকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না বানাতে চেয়ে শিল্পি হিসেবে।
নবীনদের উদ্যেশে: আমি কোন শিল্পি নই। এখনো পড়াশোনা চলছে। যারা ছবি আঁকতে বা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত যেমন কারুকাজ, গ্রাফিক ডিজাইন, আর্কিটেকচার, ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প ইত্যাদি ভালবাসে বা এসব নিয়ে থাকতে চায় তাদের প্রতি এতটুকুই বলব মন যা চায় সেটাই কর। কে কি বলে বা কি ভাবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। নিন্দুকেরা অনেক কথাই বলে। তাতে কান দিয়ে লাভ নেই। আর হ্যা, কেবল চারুকলায় পড়লেই যে শিল্পি হবে এমন টা নয়। বড় শিল্পিদের জীবনী পড়লেই জানা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক অনেক শিল্পি আছেন। বর্তমানে চারুকলায় চান্স পাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই চান্স না পেয়ে ভেঙে পড়ে। চর্চা টাই বড় বিষয়। শিল্পের চর্চাই একদিন তোমাকে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে, প্রতিষ্ঠান তো একটা অজুহাত মাত্র।আমি সব সময় একটা কথা বলি, ”প্রচুর প্রাকটিস প্রয়োজন।” প তে পরীক্ষা, প তে প্রচুর, প তে প্রাকটিস আর প তে প্রয়োজন।” জীবনে শিল্পের পরীক্ষায় শিল্পি হতে হলে অবশ্যই, “প্রচুর প্রাকটিস প্রয়োজন।”